এন্ড্রু কার্নেগী হলেন এক সময়ের অন্যতম মার্কিন ধনী ব্যক্তি। তার জীবনে তিনি যা কিছু আয় করেছেন তার সবই তিনি মানুষের সেবার জন্য দান করে গেছেন। তার জীবনের ইতিহাস থেকে জানা যায় অত্যন্ত গরীব ঘরের সন্তান ছিলেন ‘কার্নেগী’। কিন্তু কিভাবে তিনি মার্কিন ধনকুবের হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন? এর পেছনে রয়েছে একটি গল্প। সেই গল্পই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
জন্ম ও পরিবার:
১৮৩৫ সালের ২৫ নভেম্বর স্কটল্যান্ডের এক সামান্য পল্লীগ্রামের এক নগন্য পরিবারে এন্ড্রু কার্নেগীর জন্ম হয়। জীবনের প্রথম ১৩টি বছর স্কটল্যান্ডে কাটে পরিবারের সাথে। পরবর্তীতে জীবিকার তাগিদে তার বাবা সপরিবারে আমেরিকা পাড়ি জমান। আমেরিকাতে তাদের ঠিকানা হয় একটি বস্তি।
যেভাবে ধনী হওয়ার ইচ্ছা জাগল:
কার্নেগীর বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর। পোশাক-আশাক একেবারেই ভালো ছিল না। একে তো নোংরা তার উপর বিভিন্ন জায়গায় ছেড়া ছিল। এই অবস্থাতেই একদিন খেলার জন্য একটি পাবলিক পার্কে ঢুকতে যাচ্ছিলেন এমন সময় পার্কের দারোয়ান তাকে পার্কে প্রবেশ করতে দেননি। তখন বালক কার্নেগী দারোয়ানকে বলে যে, সে এই পার্ক কিনেই পার্কের ভেতরে ঢুকবে। পরে ঠিকই তিনি ওই পার্ক কিনেই পার্কের ভেতরে ঢোকেন। পার্কটি কেনার পর সেখানে একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে দেন যাতে লেখা ছিল, “আজ থেকে দিনে বা রাতে যে কোন সময়ে যে কোন মানুষ যে কোন পোশাকে এই পার্কে প্রবেশ করতে পারবে।”
জীবনের পথে এগিয়ে চলা:
একটি সুতার কলে মাসে সাড়ে বার টাকা বেতনে তাঁতির মজুর হিসেবে যোগ দেন। এটাই তার জীবনের প্রথম রোজগার। এর প্রায় এক বছর পর হঠাৎ একদিন রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে দেখেন একটি টেলিগ্রাফ অফিসের দরজায় লেখা “ছোকরা পিয়ন চাই”। ভালো চাকরি লাভের আশায় কার্নেগী অফিসের ভেতরে যান। কিন্তু পোশাক-আশাক ভালো না হওয়ায় সেই অফিসের কেরাণী তাকে বের করে দেন। কার্নেগী তার পরের দিন আবার সেই অফিসে যান চাকরির আশায়। এবারও সেই কেরাণীর কারণে অফিসের বড় সাহেবের সাথে দেখা করতে পারেননি কার্নেগী। কিন্তু চাকরিটি তার চাই-ই চাই। এই আশায় তিনি তৃতীয় দিন আবার যান সেই অফিসে। এবার আর কেরাণী তাকে তাড়িয়ে না দিয়ে বড় সাহেবের কাছে ঘটনাটি খুলে বলেন। বড় সাহেব সব শুনে বললেন, "পাঠিয়ে দাও ত, দেখি ছোকরা কি চায়।" সেইদিনই কার্নেগী টেলিগ্রাফ অফিসের কাজে ভর্তি হলেন। (বি.দ্র: উপরের ছবিতে ডান পাশে ছোট বেলার এন্ড্রু কার্নেগী)
এরপরের গল্প শুধু এগিয়ে যাওয়া:
সেদিনের সেই পিয়ন ছেলেটি একদিন টেলি-বিভাগের বড় সাহেবও হয়েছিলেন। কিন্তু কিভাবে? পিয়নের কাজ করতে করতেই নিজ মেধা দিয়ে টেলিগ্রাফের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন কার্নেগী। তারপর পিয়নের চাকরি ছেড়ে যোগ দেন স্থানীয় রেলস্টেশনের টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসেবে। এভাবে ধীরে ধীরে টেলি-বিভাগের বড় সাহেবের পদটিও অর্জন করেন কার্নেগী।
সফলতার শুরু:
টেলি বিভাগের বড় সাহেব হওয়ার পর চাকরির পাশাপাশি তিনি রেলগাড়ি ও খনির তেলের ব্যবসা শুরু করেন। খুব অল্পদিনের মধ্যেই এই ব্যবসা থেকে অনেক টাকা লাভ হতে থাকে। লাভের টাকা আরও নতুন নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে থাকেন কার্নেগী। সব ব্যবসাতেই তিনি একের পর এক সফল হতে থাকেন। এভাবে একে একে সাতটি বড় বড় লোহার কারখানা কিনে ফেলেন কার্নেগী এবং নিজস্ব তত্ত্বাবধানে সেগুলো চালাতে থাকেন। কার্নেগীর বয়স তখনও ৩৫ এর কোটায় পৌঁছেনি, এই সময়েই কার্নেগী বিশ্বের নামকরা লোহা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি তার সময়ে আমেরিকার সবচেয়ে বড় স্টিল কোম্পানির মালিক ছিলেন। একসময় ৩৪জন ক্রোড়পতি তার সংস্থায় কাজ করতেন।
বিয়ে:
১৮৮৭ সালে লুইস উইটফিল্ড এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এন্ড্রু কার্নেগী। ১৯১৯ সালে তার স্ত্রী মারা যান। মার্গারেট কার্নেগী নামে তাদের একটি মেয়ে রয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের অবসান:
১৯০২ সালে তিনি ৪০০ মিলিয়ন ডলারে তার স্টিল কোম্পানি জে, পি, মরগানের কাছে বিক্রি করে দেন, যার বর্তমান বাজারমূল্য ৩১০ বিলিয়ন ডলার।
আবার দেশে ফিরে যাওয়া:
১৯০১ সালে এসে ৫৬ বছর বয়সে ব্যবসা-বাণিজ্য বাদ দিয়ে ফিরে যান নিজ দেশ স্কটল্যান্ডে। দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে কার্নেগীর মতামত ছিল এরকম - "রোজগার যথেষ্ট করেছি, এখন এই বুড়ো বয়সে আর 'টাকা টাকা' করে ছুটে বেড়ান ভাল দেখায় না। এতদিন যা সঞ্চয় করেছি, এখন দানের মত দান করে তার সদ্ব্যবহার করতে হবে।"
দানশীলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত:
কার্নেগী তার অর্জিত সম্পদ থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা মানবতার সেবায় দান করে গিয়েছেন। বর্তমান সময়ে এই টাকার পরিমাণ খুব একটা বেশি মনে না হলেও সেই সময়ে ১০০ কোটি টাকা মানে অনেক টাকা। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কার্নেগীর দানের নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করার জন্য ২০ কোটি টাকা দান করেন কার্নেগী। কার্নেগী যেই গ্রামটিতে জন্মেছিলেন সেই গ্রামটি ছিল একটি অজোপাড়া গ্রাম। কিন্তু আজ সেটি বিশ্বের উন্নত শহরগুলোর মতোই একটি শহর হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। যার মূলে রয়েছেন কার্নেগী। এই শহরটির উন্নতির জন্য তিনি সম্পত্তি রেখে গেছেন, তার আয় হয় বছরে চার লক্ষ টাকা। বীরত্বের পুরস্কারের জন্য আমেরিকায় ও ইংল্যান্ডে তিনি দুটি 'Hero fund' বা বীর ভান্ডার স্থাপন করে গেছেন; বিপদের সময়ে অন্যের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে যারা নিজেরা আহত ও অকর্মণ্য হয়ে পড়ে, এই ভাণ্ডার থেকে তাদের খাওয়া-পরার সমস্ত খরচ দেওয়া হয়। এমনি করে ছোট বড় যত অসংখ্যরকমের দান তিনি করে গেছেন।
জীবন সম্পর্কে কার্নেগীর বক্তব্য:
জনৈক ব্যক্তি একদিন কার্নেগীকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি কিভাবে মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করেন। এন্ড্রু কার্নেগী জবাব দিলেন, "মানুষ নিয়ে কারবার করা যেন সোনার জন্য মাটি খোঁড়ার মত। এক আউন্স সোনার জন্য টনের পর টন মাটি কাটতে ও সরাতে হয়। কিন্তু সোনাই খোঁজা হয়, মাটি নয়। আসল কথা, আমাদের নজর কোনটার উপর? নজরটা সোনার উপর থাকুক মাটির উপর নয়। মানুষের মধ্যেও যদি দোষত্রুটি খোঁজা হয়, তবে মাটির মত অনেক পাওয়া যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে আপনি কি খুঁজছেন?
বড়লোক হবার সখ থাকলেই যে মানুষ বড়লোক হতে পারে না তার দৃষ্টান্ত গল্পে আমরা অনেক পড়েছি। কিন্তু বাস্তব জীবনেও অনেকে ইচ্ছাশক্তি ও চেষ্টা দ্বারা অনেক কিছু করতে পারে ‘এন্ড্রু কার্নেগী’ তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
মৃত্যু:
১৯১১ সালের ১১ আগষ্ট দানশীল ‘এন্ড্রু কার্নেগী’ মৃত্যুবরণ করেন।
Post a Comment