DHAKA WEATHER

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্প অবলম্বনে ছুটি: দ্য ভ্যাকেশন

বালকদিগের লিডার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট করিয়া একটা নূতন ভাব নক করিল। সদ্য ক্রয়কৃত স্মার্টফোনখান পকেটেই ছিল; স্থির করিল সকলে মিলিয়া একখানা গ্রুপ সেলফি তুলিবে। সেটি সকলকে ট্যাগপূর্বক ফেসবুকে আপলোডের পর কী পরিমাণ লাইক-কমেন্ট আসিবে, তাহা উপলব্ধি করিয়াই বালকেরা এই প্রস্তাবে সোৎসাহে সায় জানাইতে কালবিলম্ব করিল না।
মুখ বাঁকাইয়া সকলে যখন সেলফি তুলিতে মনোনিবেশ করিয়াছে, সেই সময় ফটিকের কনিষ্ঠ মাখনলাল বালকদিগের সেলফি স্টিকখানা লইয়া দৌড়াইয়া চলিয়া গেল। ছেলেরা তাহার এই অভূতপূর্ব চৌর্যবৃত্তিতে যুগপৎ বিরক্ত ও বিমর্ষ হইল। একজন গিয়া ভয়ে ভয়ে তাহার কাছে সেলফি স্টিকখানা ফেরতও চাইল। কিন্তু তাহাতে সে কিছুমাত্র বিচলিত হইল না। অবশেষে ফটিক আসিয়া আস্ফালন করিয়া কহিল, ‘দেখ, মার খাবি! এইবার স্টিকটা দে।’
সে তাহাতে আরও একটু দূরে সরিয়া গেল। এইরূপ অবস্থায় সাধারণের নিকট প্রেস্টিজ রক্ষা করিতে হইলে ফাজিল ভ্রাতার গণ্ডদেশে অনতিবিলম্বে এক চড় কষাইয়া দেওয়া আবশ্যক হইয়া পড়ে। তাই সে ভ্রাতার গণ্ডদেশে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির ন্যায় ‘ফিঙ্গার প্রিন্ট’ বসাইয়া দিল।
সেলফি তোলার প্রারম্ভেই এইরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ফলে বালকেরা গ্রুপ সেলফি তোলার মনোবাসনা বিসর্জন দিল। মাখনলাল তাহার ফুলিয়া ওঠা গাল লইয়া যাত্রা করিল বাড়ির দিকে। আর ফটিক মন খারাপ করিয়া প্লে-স্টোর হইতে ‘ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস’ ডাউনলোড করিয়া পথের পার্শ্বে অবস্থিত দেয়ালের উপর বসিয়া খেলিতে লাগিল নিবিষ্ট চিত্তে। এমন সময় একটা মোটরসাইকেল আসিয়া দাঁড়াইল ফটিকের সামনে। মোটরসাইকেলে বসিয়া থাকা বাবুটি বালককে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘চক্রবর্তীদের বাড়ি কোথা?’ ফটিক বলিল, ‘ওই হোতা।’ কিন্তু কোনদিকে যে নির্দেশ করিল তাহা বুঝিবার ক্ষমতা দিকনির্দেশক যন্ত্রেরও নাই। মোটরসাইকেলওয়ালা পুনরায় শুধাইলেন, ‘কোথা?’ ফটিক বলিল, ‘জানিনে। গুগলম্যাপ হইতে খুঁজিয়া নেন।’
মোটরসাইকেলওয়ালা গুগল ম্যাপের সাহায্যে কোনোমতে চক্রবর্তীদের বাড়ির পথ খুঁজিয়া লইলেন।
গেমস শেষে ফটিক ফেসবুকে লগইন করিয়া ‘গুড আফটারনুন ফ্রান্স!’ লিখিয়া একখানা আবশ্যক স্ট্যাটাস প্রদান করিয়া বাড়ির দিকে পা বাড়াইল।
ফটিককে দেখিবামাত্র তাহার মা অগ্নিমূর্তি ধারণ করিয়া কহিলেন, ‘আবার তুই মাখনকে মারিয়াছিস!’ ফটিক কহিল, ‘না, মারিনি।’
‘ফের মিথ্যা কথা বলছিস!’
‘কক্ষনো মারিনি। মাখনকে জিজ্ঞাসা করো।’
এমন সময় মোটরসাইকেলওয়ালা বাবুটি ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, ‘হোয়াটসআপ গাইজ?’
ফটিকের মা অতি আনন্দে অভিভূত হইয়া বলিলেন, ‘ওএমজি! তুমি কবে এলে, ব্রো?’
বহুদিন হইল ফটিকের মামা পশ্চিমে কাজ করিতে গিয়াছেন। ইতিমধ্যে ফটিকের মার দুই সন্তান হইয়াছে। গত বছর তাহার স্বামীও মারা গিয়াছেন।
ফটিকের মামা কহিলেন, ‘কী করিব, বল? তোদের নম্বর আমার কাছে ছিল না। ফটিকের ফেসবুক আইডিও আমার জানা নাই। নইলে তো মেসেঞ্জারে ফ্রিতে কল দিয়া তোদের খবর নিতে পারিতাম।’
কিছুদিন খুব সমারোহে কাটিয়া গেল। অবশেষে ফিরিয়া যাওয়ার দুই দিন আগে ফটিকের মামা ফটিককে তাহার সঙ্গে লইয়া যাওয়ার প্রস্তাব করিলেন। ফটিকের মা-ও রাজি হইলেন সহজেই, কিন্তু ফটিক হইল না। অনেক দেনদরবারের পর সে-ও রাজি হইল। অবশেষে যাত্রাকালে ঔদার্যবশত তাহার পুরাতন স্মার্টফোন আর সেলফি স্টিকখানা মাখনকে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে ভোগদখল করিবার পুরা অধিকার দিয়া গেল।
মামার বাড়ি পৌঁছিয়া প্রথমত মামির সঙ্গে আলাপ হইল। মামির তিন কন্যা, কোনো পুত্র নাই। ফটিককে পুত্র হিসাবে পাইয়া আনন্দে আটখানা হইয়া গুনিয়া গুনিয়া নয়খানা সেলফিও তুলিলেন মামি। পরবর্তীকালে তাহা ফেসবুকে আপলোড করিয়া ক্যাপশনে লিখিলেন, ‘কে বলে আমার ছেলে নাই! ফটিকই আমার ছেলে!’
মামির মনে হইল, ১৩-১৪ বছরের ছেলেদের মতো পৃথিবীতে এত স্টাইলিশ আর কেহ নাই। উহাদের খাদ্যগ্রহণের উদ্রেক নাই, একখানা স্মার্টফোন আর ওয়াই-ফাইয়ের কানেকশন থাকিলেই সন্তুষ্ট। ফেসবুক আছে, ইনস্টাগ্রাম আছে। আর তাহারা মাতিয়া থাকে মোবাইল ফোনের গেমসে। উহাদের মুখে ভুল উচ্চারণের আধুনিক কথাও কর্ণে আরাম দেয়।
ফটিকও উপলব্ধি করিল, সে অনেক শান্তির জায়গায় আসিয়া পড়িয়াছে। বাসায় ওয়াই-ফাইয়ের লাইন কিংবা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা নাই। এইখানে তাহার সবই বর্তমান। গ্রামে এইরূপ সুযোগ-সুবিধা অমাবস্যার চাঁদ দেখিবার মতো ব্যাপার।
চারিদিকের স্নেহমমতায় ফটিক ভাসিয়া গেল। যখনি যেথায় ঘুরিতে যায়, তখনি ‘চেক ইন’ দিয়া ফেসবুকবাসীকে জানিবার সুযোগ করিয়া দেয়। এমনি করিয়া কাটিয়া যাইতে লাগিল দিন। ফটিক আর গ্রামের কথা মনেও আনে না।
তবে তাহার মামা খুব করিয়া চাইতে লাগিলেন, ফটিক একবার গ্রাম হইতে ঘুরিয়া আসুক। তাই একদিন ফটিককে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কী রে, বাড়ি যাবি কবে? তোর ছুটি কোন মাসে?’ আচমকা এমন অপ্রিয় প্রশ্ন শুনিয়া ফটিক কহিল, ‘সে এখনো অনেক দেরি।’
মামা বলিলেন, ‘ও। ছুটি হইলে গ্রাম থেকে ঘুরিয়া আসিস।’
এদিকে একদিন লোকাল বাসে উঠিবার পর অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়িল ফটিক। সেদিন তাহার সাধের স্মার্টফোনখানাও বিসর্জন দিয়া আসিল সে। বাড়িতে আসিয়া কাউকে কিছু বলিবার সাহস সে করে না। তবুও মামিকে গিয়া বলিল, ‘মামি, আমি আমার ফোনখানা হারাইয়াছি।’
মামি হারানো সংবাদ শুনিয়া কালবিলম্ব না করিয়া তাহার আইফোনখানা ফটিককে প্রদান করিয়া কহিলেন, ‘নে বাবা, আজ থেকে এটা তোর।’ মামির এইরূপ ঔদার্য দেখিয়া ফটিক তাহার প্রতি আরও কৃতজ্ঞ হইল। আবেগে চোখে জলও আসিল।
কিছুদিন বাদে মামা আবার স্কুল ছুটির কথা জিজ্ঞাসা করিলে ফটিক ‘ছুটি নাই’ বলিয়া দ্রুত প্রস্থান করিল। ওদিকে ফটিকের মা নিয়মিত বিশ্বম্ভরবাবুকে ফোন করিয়া বলিতে লাগিলেন, তিনি যেন ফটিককে কিছুদিনের জন্য গ্রামে পাঠাইয়া দেন। তবে একসময় ফটিকের মুখে ‘ছুটি নাই ছুটি নাই’ শুনিয়া মিথ্যার ঘ্রাণ পাইলেন মামা। ফটিক প্রতিদিন স্কুলের নাম করিয়া বাহির হইয়া যায়।
মামা আবার আরেক দিন ফটিকের স্কুল ছুটির খবর জানিতে গিয়া খবর পাইলেন যে স্কুল নাকি সপ্তাহখানেক আগেই বন্ধ হইয়াছে। ফটিকের এমন মিথ্যা তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না। পরদিন সকালে তিনি ফটিককে কহিলেন, ‘আজ তুই আমার বাইকে করিয়া যাবি। আমি তোকে স্কুলের সামনে নামাইয়া দিয়া অন্যদিকে যাত্রা করিব।’ ফটিক অত্যন্ত আনন্দের সহিত মোটরসাইকেলে উঠিয়া পড়িল। কিন্তু এ কী! মামা যে তাহাকে রেলস্টেশনে নিয়া আসিলেন! ফটিক কিছু বুঝিবার আগেই মামা তাহাকে ট্রেনে উঠাইয়া দিয়া কহিলেন, ‘যা বাবা। কিছুদিন গ্রামে কাটাইয়া আয়। এইবার তোর ছুটি হইয়াছে।’
ট্রেন ছাড়িয়া দিল। ফটিকের দুই চোখ হইতে অশ্রু গড়াইতেছে। একখানা স্ট্যাটাস দিয়া যে মনের কষ্ট ভাগাভাগি করিবে, সেই উপায়ও তো নাই! হাতের স্মার্টফোনখানা অচল। চলিবে কী করিয়া, ওয়াই-ফাই সংযোগই যে নাই! মান্ধাতার আমলের রেল ব্যবস্থা লইয়া একখানা স্ট্যাটাস মাথায় আসিল ফটিকের। কিন্তু এই বিদ্রোহী স্ট্যাটাস সে ব্যক্ত করিবে কোথায়?

Copy From:

Post a Comment

Previous Post Next Post